লালন হিন্দু কি মুসলমান এনিয়ে বিস্তর মতামত পাওয়া যায়। কারো মতে লালন কায়স্থ পরিবারের সন্তান তাঁর পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী; পরে লালন ধর্মান্তরিত হন। গবেষকদের মধ্য বেশিরভাগই মনে করেন লালন মুসলিম তন্তবায় পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান, মাতার নাম আমিনা খাতুন।
লালন ফকির নিজের জাত পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন –
সবে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে।
কারে বা কি বলি আমি
দিশে না মেলে।।
রোগমুক্তির কিছুদিন পর লালন ফকির বিদায় চাইলেন, বললেন আমি সংসার ত্যাগী মানুষ; এই ভব সংসারে আমার ঠাই নাই। কথিত আছে লালন অলৌকিক ভাবে হেঁটে কালিগঙ্গা নদি পার হয়ে যায়। পরে অবশ্য মলম ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে পার হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে লালনকে ধরে ফেলে এবং ছেউড়িয়া ফিরে জাবার জন্য ব্যাথিত হৃদয়ে অনুরোধ করে। লালন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে যে, যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে।নিঃসন্তান মলম তাঁর প্রিয় সন্তানের কথা রাখলেন। কালিগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমণ্ডিত মলমের বাগানে তৈরি হলো চৌচালা ঘর আর আঁখরাবাড়ি। চৌচালা ঘরটি লালন সাধন কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
কালের নিয়মে ছনের ঘরটি বিলীন হয়ে গেলেও মহান সাধক লালনের পরশমাখা সাধন কক্ষের কপাটজোড়া এবং জলচৌকি এখোনো লালন একাডেমির যাদুঘরে রাখা আছে। এই আঁখরাবাড়িটিই ক্রমে ভজনের পুণ্যধামে পরিনিত হয়। ফজরের নামাজের পর মাওলানা মলম কোরআন পাঠ করতেন, ফকির লালন মনোযোগ দিয়ে তেলওয়াত শুনতেন, মানে জিজ্ঞাসা করতেন। লালন কোরআনের কিছু কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা করতেন, ব্যাখ্যা শুনে মাওলানা মলম অভিভূত হয়ে যেতেন।
লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও অনুরাগে অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে। মলম কারিকর থেকে হয়ে যান ফকির মলম শাহ্ অন্যদিকে মতিজান হয়ে যান মতিজান ফকিরানী। ফকির মলম শাহ্ ছিলেন সর্বাপেক্ষা বয়স্ক শিষ্য। মলমের অপর দুইভাই কলম ও তিলম সস্ত্রিক পর্যায়ক্রমে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
লালনের মুখে বসন্তের দাগ ছিল, তাঁর হাত দুটো এতো লম্বা ছিলো যে দাঁড়ালে আঙুল গুলো হাঁটুর নিচে পড়তো। উঁচু নাক, উন্নত কপাল আর গৌরবর্ণের লালনের ছিলো গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ। কাঁধ বরাবর বাবরী চুল, লম্বা দাড়ী, হাতে ছড়ী, পায়ে খড়ম, গায়ে খেলকা, পাগড়ী, আঁচলা, তহবন- সব মিলিয়ে যেন এক সিদ্ধপুরুষ, পরিপূর্ণ সাধক।
লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তাঁর মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন- “পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে”। লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ্ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন। লালনের জিবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ফকির মানিক শাহ্ সেই সময়ের একজন শ্রেস্থ গায়ক ছিলেন। লালনের শিষ্যদের ধারণা তাঁর গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশী। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এতো বিপুল সংখ্যক গান পাওয়া যায়না। শোনা যায় লালনের কোন কোন শিষ্যর মৃতর পর গানের খাতা তাঁদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি।
No comments:
Post a Comment